দিন কয়েক আগে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড তাদের খেলোয়াড়দের সঙ্গে নতুন চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে। সেখানে বোঝা গেছে দেশটির মনোযোগ পাইপলাইনে থাকা ক্রিকেটারদের দিকে। হ্যারি ব্রুকদের মতো তরুণদের নিয়েছে ৩ বছরের চুক্তিতে। প্রতিভাবান এই তরুণদের দিকে বোর্ডের নজর থাকে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই। যুব বিশ্বকাপ যার অন্যতম একটা মাধ্যম। যেখানে বিরাট কোহলি, স্টিভ স্মিথ ও কেন উইলিয়ামসনরা দ্যুতি ছড়িয়েছেন। পরবর্তীতে তারা বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করে এখন ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে। তাদের পথ অনুসরণ করছেন একালের রাচিন রবীন্দ্র ও শুবমান গিলরা। আগামীর বার্তা দিচ্ছেন তারা। ব্যাটে ছড়াচ্ছেন আলো। কিন্তু তাদের সমসাময়িক বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা তলিয়ে গেছেন অন্ধকারে।
২০০৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপাটা উঠেছিল বিরাটের হাতে। যিনি তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছিলেন। সেবার নজর কেড়েছিলেন ভারতীয় দলের সহ-অধিনায়ক রবীন্দ্র জাদেজাও। দুজনে এখন ভারতের হয়ে বিশ্ব ক্রিকেট মাতাচ্ছেন। কোহলি এখন আছেন শচিন টেন্ডুলকারের রেকর্ডকে টপকে যাওয়ার অপেক্ষায়।
সেই আসরে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন কেন উইলিয়ামসন। দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেমিফাইনালে। কিন্তু ভারতের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়। দুটি বিশ্বকাপ ফাইনালে হয়েছেন রানার্সআপ। একবার শিরোপা জিতেছেন টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের। এই বিশ্বকাপে ইনজুরিতে কাটালেও আছেন দলের সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ স্মিথ সেই আসরে ছিলেন একজন ব্যাটসম্যান। কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটে এখনো আছে তার কদর। তাকে সমীহ করে পরিকল্পনা আঁটতে হয় প্রতিপক্ষ বোলারদের। নিজের শেষ বিশ্বকাপেও আছেন দারুণ ছন্দে।
এই তিন ক্রিকেটারের পথ ধরেই বলা যায় ২০১৮ সালে বিশ্ব ক্রিকেট পেয়েছে আরও তিন মূর্তিকে। তাদের মধ্যেও আছেন ভারতীয় আর কিউই। অন্যজন অবশ্য আফগান। তারা শুবমান গিল, রাচিন রবীন্দ্র ও রহমানউল্লাহ গুরবাজ। এ বছরও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছিলেন অধিনায়ক পৃথ্বি শ। তার সহযোগী অধিনায়ক ছিলেন গিল। সেই গিল আজ ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম ব্যাটিং ভরসা। ওপেনিংয়েও নিজের জায়গাটা করে নিয়েছেন পাকা। তিনটি ফিফটি ও একটি সেঞ্চুরিতে ৩৭২ রান করে যুব বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছিলেন তিনি। সেই পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা চলছে এখনো। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত না হলে ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে তাকে আরও বিধ্বংসী রূপে দেখা যেত।
কিউই ব্যাটসম্যান রাচিন রবীন্দ্র নিজের অভিষেক বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই করেছেন সেঞ্চুরি। হয়েছেন খবরের শিরোনাম। আলো ছড়াচ্ছেন বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচেই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শতরান করে দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন জয়ের খুব কাছাকাছি। আছেন আসরের সেরা রান সংগ্রাহকদের তালিকায়। নিয়মিত অধিনায়ক উইলিয়ামসনের ইনজুরির কারণে ওপরে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। আর পেয়েই তা কাজে লাগিয়েছেন। গোধূলিলগ্নে থাকা ক্রিকেটারের অভাব কোনোভাবেই বুঝতে দিচ্ছেন না উদীয়মান এই তারকা। ব্যাট হাতে যেন বলে দিচ্ছেন, তিনিই রাজ করবেন আগামীর ২২ গজে।
এই ক্রিকেটারদেরই যুব বিশ্বকাপ ব্যাচের আরও দুই সদস্য রহমানউল্লাহ গুরবাজ ও ইব্রাহিম জাদরান। আফগানিস্তানের ব্যাটিংয়ে যেন ত্রাতা তারা। এই মুহূর্তে দলকে দিচ্ছেন ভরসা। পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের পথেও তারা রেখেছেন ভূমিকা। তারাও বার্তা দিচ্ছেন আগামীর।
কিন্তু উল্টো চিত্র বাংলাদেশের বেলায়। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলা ক্রিকেটারদের আজ খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। মোহাম্মদ মিঠুন, নাসির হোসেন, সোহরাওয়ার্দী শুভ, রুবেল হোসেন। রুবেল ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে তোলার পথে নায়ক। কিন্তু বাকিরা হারিয়ে গেছেন কক্ষপথ থেকে। সৈকত আলি, রনি তালুকদাররা এখনো পাইপলাইনে। একই দৃশ্য ২০১৮ সালের দলটির বেলায়ও। যে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন সাইফ হাসান। তার সতীর্থ আফিফ হোসেন, নাইম শেখরাও খেলেছেন জাতীয় দলে। কিন্তু কেউই নিজেদের জায়গা ধরে রাখতে পারেননি। তারা যেন অন্ধকারে তলিয়ে গেছেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘আসলে ক্রিকেটারদের কোনো দায় নেই এখানে। প্রতিযোগিতাই তো হয় না সেভাবে। একসময় ঢাকার লিগে দলগুলো ছিল একে অপরের চোখে ভিলেন। আর এখন সবাই সবার ভাই। ক্রিকেট সংস্কৃতি কিংবা অবকাঠামোর উন্নয়ন না হলে ক্রিকেটারদের কাছ থেকে মানসম্পন্ন পারফরম্যান্স আসবে না।’
শুধু নাঈম-আফিফরাই না। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপজয়ী দলটির অনেক ক্রিকেটারই হারিয়ে ফেলেছেন ছন্দ। সেই দলটির ক্রিকেটার তানজিদ তামিম, শরিফুল ইসলাম, তাওহীদ হৃদয়, তানজিম সাকিবরা জাতীয় দলে জায়গা করেছেন। তবে তাদের অধিনায়ক আকবর আলির এখনো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে অভিষেক হয়নি। বিধ্বংসী ফিনিশার হয়ে আলোচনায় আসা শামীম পাটোয়ারীও কক্ষপথ হারিয়েছেন। ঘুরেফিরে টাইগারদের হাল ধরেন সেই পাণ্ডবরাই। এখনো ছয়ে নেমে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সেঞ্চুরি বলে দেয় দেশের ক্রিকেটের পাইপলাইন কত দুর্বল। বিসিবিরও সব মনোযোগ জাতীয় দলকে ঘিরেই। অথচ অন্যসব দেশ সবার আগে নজর দেয় সেদিকেই।